Logo
Logo
×

বাতায়ন

যে কারণে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রয়োজন

Icon

ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যে কারণে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রয়োজন

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি নারীবিষয়ক, শ্রম অধিকার, স্বাস্থ্য এবং গণমাধ্যম সংস্কারের উদ্দেশ্যে চারটি নতুন কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠিত কমিশনের মোট সংখ্যা দশে উন্নীত হলো। এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, যেমন-সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্দেশ্যে ছয়টি পৃথক কমিটি গঠন করে। একজন স্থানীয় সরকার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গ্রামীণ উন্নয়নবিষয়ক গবেষক হিসাবে দেশের অন্যান্য জনসাধারণের মতো আমিও স্থানীয় সরকারের ওপর একটি সংস্কার কমিশন আশা করেছিলাম। দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত উন্নয়ন অর্জনের জন্য স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন কেন জরুরি, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

সম্প্রতি দেশব্যাপী সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকারের অন্যসব স্তরের জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপক পদত্যাগ, অব্যাহতি ও অপসারণের ফলে যে ব্যাপক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণের লক্ষে সরকার প্রশাসক নিয়োগ করেছে। পূর্ববর্তী প্রতিনিধিদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেতৃত্বের অভাব এবং সরকারি পরিষেবাগুলোতে আসন্ন ব্যাঘাত সম্পর্কে উদ্বেগ, এ আশু পদক্ষেপের পথকে সহজ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এ কার্যক্রমকে স্মার্ট পদক্ষেপ বলে জনগণ প্রশংসা করেছে। কারণ স্থানীয় সরকারে নিয়োজিত প্রায় সব প্রতিনিধিই আওয়ামী লীগের শাসনামলে অন্যায্য ও প্রতিনিধিত্বহীন নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আগস্টে যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হন, তখনই প্রায় সব প্রতিনিধি পদ থেকে সরে পড়েন। তবে স্বীকার করতেই হবে, এটি একটি অস্থায়ী সমাধান। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে স্থায়ী সমস্যার সমাধান হবে না। সরকারি প্রতিনিধি যেমন, অতিরিক্ত সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সহকারী কমিশনারদের (ভূমি) শহর ও গ্রামীণ এলাকার স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে সাময়িক দায়িত্ব পালনের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে।

অন্যদের মতো আমিও বিশ্বাস করি, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির পেছনে ব্যাপক দুর্নীতি, অনৈতিক আচরণ, স্বজনপ্রীতি ও স্থানীয় সরকার পরিচালনাকারী ব্যবস্থার রাজনীতিকরণ জড়িত। এসব সংকটের কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়াও আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কার প্রচেষ্টা ও তার মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। এ রকম একটি ক্ষেত্র হলো স্থানীয় সরকার বিভাগ। শাসন, সেবা প্রদান ও একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিত্ব উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দেশে একটি সাধারণ ঐকমত্য রয়েছে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো আংশিকভাবে নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন কমিশনের আওতাভুক্ত। তবে এ সেক্টরে সামগ্রিক কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য আরও অধ্যয়ন ও সংস্কার প্রয়োজন। এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা খুব একটা কার্যকর নয় এবং এর নাগরিকরা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পায় না। এর অন্যতম কারণ হলো, কেন্দ্রীয় সরকারের তুলনায় স্থানীয় সরকারের অপর্যাপ্ত তহবিল। এর বার্ষিক যে পরিমাণ ব্যয়, তা সব সরকারি ব্যয়ের ৭ থেকে ৮ শতাংশ মাত্র। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার কাঠামো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা ও কাঠামোগত সমন্বয়ের জন্য ১৮ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। আবার ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের পর সরকার স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করে। উভয় কমিশন পদ্ধতিগত সংস্কারের পরামর্শ দিলেও, সেগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।

আমরা বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আইনি ভিত্তির মৌলিক বিষয়গুলো বলতে শুধু সংবিধানকেই বুঝি। সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে, আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হবে। ৫৯(২) ধারা অনুযায়ী, সংবিধান ও অন্য কোনো আইন-সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করবেন, অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লিখিত অনুরূপ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেরূপ দায়িত্ব পালন করবেন এবং অনুরূপ আইনে প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য, জনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনসাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।

উপজেলা পরিষদ আইনের ৪২(৩) ধারা পরিষদকে স্থানীয় সংসদ-সদস্যের সঙ্গে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা সমন্বয়ের বিধান করেছে। সে সম্পর্কে বছরের পর বছর ধরে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, তা ফলপ্রসূ নয়; বরং এটি স্বার্থের দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি করে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় এমপিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও তাদের উপদেশমূলক ভূমিকার আধিক্যের কারণে বাংলাদেশের স্থানীয় প্রশাসন অনেকাংশে অকার্যকর। সাংসদরা স্থানীয় শাসনে হস্তক্ষেপ করেন। ফলে জনসম্পদ বিচ্ছিন্ন বণ্টন, তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ, অসদাচরণ, স্বজনপ্রীতি ও স্বার্থের সংঘাতের ঝুঁকি বেড়েছে।

এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারবিষয়ক বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের ‘বাংলাদেশ : রিফর্ম এজেন্ডা ফর লোকাল গভর্ন্যান্স’ শীর্ষক বইয়ের সুপারিশগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে। অধ্যাপক আহমেদের মতে, স্থানীয় সরকার সংস্কার দেশের বর্তমান শাসন সংকট নিরসনের জন্য অপরিহার্য, তবে তা জাতিকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার জন্য অপর্যাপ্ত। বাংলাদেশকে যত দ্রুত সম্ভব মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে, স্থানীয় সরকার সংস্কারের পাশাপাশি মাঠ/স্থানীয় প্রশাসনের সংস্কার প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের একটি অংশ হলো প্রস্তাবিত একটি কাঠামোগত আইন, যা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রভাবশালী মেয়র এবং চেয়ারম্যানদের জন্য বর্তমান প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় ব্যবস্থার অধীনে পরোক্ষ নির্বাচনের পরামর্শ দেয়। নারীদের সংরক্ষিত আসনের জন্য পর্যায়ক্রমিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নির্বাচনি সংস্কারের অংশ। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমকে সহজতর করা এবং জটিল ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইনি কাঠামোকে আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে অধ্যাপক আহমেদ সাংবিধানিক সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত অসংখ্য সংস্কার এজেন্ডা রয়েছে। তবে এর মধ্যে কয়েকটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে দলভিত্তিক নির্বাচন ঘিরে বিতর্ক; ২৫ নং অনুচ্ছেদ যা সংসদ-সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করার বিধান করেছে, তা পুনঃপরীক্ষা; সোশ্যাল সেফটিনেট প্রোগ্রামের দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি; বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অপব্যবহার; জনবলের অভাব, উন্মুক্ত পদে নিয়োগের সুযোগ না থাকা ও অদক্ষ কর্মী; প্রয়োজনীয় অংশীজনের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকা, যার ফলে প্রকল্পের অগ্রাধিকার ভুলভাবে সংগঠিত হয়; সঠিক বাজেট, হিসাব তৈরি ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অসুবিধা; স্থানীয় সংস্থাগুলোতে সরকারি তহবিল বণ্টনে বৈষম্য; দায়িত্ব ও সম্পদের মধ্যে অমিল, যা নির্বাচিত কর্মকর্তাদের হতাশ করে এবং জনসাধারণকে অসন্তুষ্ট করে; স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর কার‌্যাবলির মধ্যে মানুষের নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের এজেন্ডার অনুপস্থিতি; দুর্বলভাবে পরিচালিত স্থানীয় তথ্যের ভিত্তি, যা জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য নয়; পরিবেশগত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ ও স্থানীয় সংস্থাগুলোতে অন্তর্ভুক্তির অভাব; এবং অর্থ ও প্রকল্পের জন্য পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন ও নিরীক্ষা পদ্ধতির অভাব। এসব দিকে মনোনিবেশ করে তা সংস্কার করা আবশ্যক।

বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা নীতি বাস্তবায়ন, প্রয়োজনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পণ্য ও পরিষেবা বিতরণ, রাষ্ট্রের ওপর প্রশাসনিক ভার কমিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার ও অনুশীলন সম্পর্কে নাগরিকদের শিখন, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে লালন-পালন ও চুক্তিকে সহজ করে তোলে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বিরোধ নিষ্পত্তি, স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করে স্থানীয় প্রশাসন। দেশের অধিকাংশ নাগরিক প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে স্থানীয় সরকারের সুবিধা ভোগ করে থাকে। তাই তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সব ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। আমরা মনে করি, সামগ্রিকভাবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য একটি কমিশন গঠনের কথা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম